মধ্যপ্রাচ্যের কোনো দেশই নিরাপদ নয়

- আপডেট সময় : ০৪:৪৫:০০ অপরাহ্ন, মঙ্গলবার, ২৩ সেপ্টেম্বর ২০২৫ ৩৪ বার পড়া হয়েছে
কাতারের দোহায় অবস্থানকারী হামাসের একটি দলের ওপর হামলা চালিয়েছে ইসরাইল। যখন মধ্যস্থতাকারীরা সর্বশেষ যুদ্ধবিরতি চুক্তি নিয়ে আলোচনায় বসেছিলেন, তখনই এ হামলা চালানো হয়। বহু বছরের কঠোর প্রচেষ্টার মাধ্যমে গড়ে তোলা কূটনৈতিক সমাধানের পথ নস্যাৎ করে দেওয়ার জন্যই মরিয়া হয়ে ইসরাইল এ হামলা চালায়।
এই হামলা শুধু গাজায় যুদ্ধবিরতি প্রচেষ্টার ওপর আঘাত নয়; এটি কূটনীতি ও আন্তর্জাতিক ব্যবস্থার প্রতিও হুমকি। দোহা দীর্ঘদিন ধরে আঞ্চলিক কূটনীতির একটি কেন্দ্র হিসেবে কাজ করছে। হামাসসহ সব পক্ষের সঙ্গে তারা আলোচনা চালিয়ে আসছে। খবরে বলা হয়েছে, ইসরাইলি হামলার সময় দোহায় সিনিয়র হামাস নেতারা বৈঠকে বসেছিলেন। সেই বৈঠকে তারা যুদ্ধবিরতির ক্ষেত্রে একটি আমেরিকান প্রস্তাবনা নিয়ে আলোচনা করছিলেন।
এই হামলা কোনো যুদ্ধক্ষেত্রের সংঘর্ষ ছিল না। ছিল চলমান রাজনৈতিক প্রক্রিয়ার ওপর হামলা। কাতারের ভেতর হামলা চালিয়ে ইসরাইল মারাত্মক সীমালঙ্ঘনের ঘটনা ঘটিয়েছে। কারণ কাতারই দীর্ঘদিন ধরে আলোচনার জন্য নিরপেক্ষ পরিবেশ সৃষ্টির চেষ্টা চালিয়ে এসেছে। এ হামলার ফলে আলোচনার মাধ্যমে সমাধানে পৌঁছার সম্ভাবনা মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
এমন একসময় হামলাটি ঘটেছে, যখন মধ্যপ্রাচ্যের আঞ্চলিক নিরাপত্তা পরিস্থিতি ক্রমেই অবনতির দিকে ধাবিত হচ্ছে। গত কয়েক দশকেও মধ্যপ্রাচ্য এত বেশি ঝুঁকির মধ্যে ছিল না। গত কয়েক সপ্তাহে ইসরাইল গাজার বাইরে ব্যাপকভাবে সামরিক অভিযান পরিচালনা করেছে। লেবানন, পশ্চিমতীর, সিরিয়া, তিউনিসিয়া, ইয়েমেন এবং এখন কাতারে হামলা চালিয়েছে দেশটি।
এ হামলাগুলো কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়, বরং সুপরিকল্পিত কৌশলের অংশ। এর উদ্দেশ্য হলো স্বাধীন রাষ্ট্রগুলোকে দুর্বল করা এবং অঞ্চলটিকে অস্থিতিশীল করে তোলা। বর্তমান পরিস্থিতি ১৯৪৮ সালের নাকবা-পরবর্তী অস্থিরতার সঙ্গে মিলে যায়। জায়োনিস্ট প্রকল্প টিকিয়ে রাখতে নতুন করে এই আঞ্চলিক অস্থিরতা সৃষ্টি করা হচ্ছে। তাই এ সংঘাত আর শুধু প্রতিরোধের প্রশ্নে সীমাবদ্ধ নেই। এটি এখন আঞ্চলিক অবস্থাকে আমূল পরিবর্তনের দিকে নিয়ে যাবে।
এ অবস্থা উপসাগরীয় অঞ্চলের নীতিনির্ধারকদের সামনে চারটি চ্যালেঞ্জ হাজির করেছে।
প্রথমত, সাম্প্রতিক সময়ের ধারাবাহিক ইসরাইলি হামলা থেকে স্পষ্টÑএই অঞ্চলের কোনো দেশই ইসরাইলের নাগালের বাইরে নয়। পাকিস্তান থেকে মরক্কো আর তুরস্ক থেকে সুদান পর্যন্ত প্রতিটি দেশই একই ধরনের হামলার শিকার হতে পারে। সাম্প্রতিক এ হামলাকে শুধু কাতারের ওপর একটি হামলা আকারে দেখলে চলবে না, এটিকে দেখতে হবে রাষ্ট্রের সার্বভৌম সুরক্ষার ধারণার ওপর চ্যালেঞ্জ হিসেবে। ভয়-ভীতি ও শক্তি প্রয়োগের মাধ্যমে ইসরাইল এ অঞ্চলের কৌশলগত মানচিত্র পরিবর্তনের চেষ্টা করছে। যুক্তরাষ্ট্রের সহযোগিতা নিয়ে এই এলাকার রাজনৈতিক এবং আঞ্চলিক সমীকরণ নিজেদের মতো করে সাজাতে যেকোনো ধরনের সামরিক শক্তি ব্যবহারে তারা প্রস্তুত।
যদি এই আক্রমণের কোনো কড়া জবাব না দেওয়া হয়, তাহলে এ ধরনের আন্তঃসীমান্ত আক্রমণ ভবিষ্যতেও চলতে থাকবে এবং অন্য রাষ্ট্রগুলোও এ ধরনের কাজে উৎসাহিত হবে। ফলে যেসব বিধিব্যবস্থা কয়েক দশক ধরে আঞ্চলিক যুদ্ধ সীমিত রাখতে এবং ক্রমবর্ধমান দ্বন্দ্ব নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করেছে, সেগুলোও অকার্যকর হয়ে যাবে।
দ্বিতীয়ত, এই চলমান সংকটের কেন্দ্রে রয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। ওয়াশিংটনের রাজনৈতিক, সামরিক ও গোয়েন্দা সহায়তা না থাকলে গাজার ওপর চলমান গণহত্যা থেমে যেত। আর এর আঞ্চলিক প্রভাবও এভাবে ছড়িয়ে পড়ত না।
এত বড় একটি সামরিক অভিযানের ব্যাপারে মার্কিন কর্মকর্তারা অজ্ঞ ছিলেন, এটা বিশ্বাসযোগ্য নয়। তারা সরাসরি অনুমোদন না দিলেও, তাদের নীরবতা এবং অস্ত্র ও গোয়েন্দা তথ্যের অব্যাহত সরবরাহের ফলে যুক্তরাষ্ট্রকে এ ঘটনার সহযোগী শক্তি হিসেবেই বিবেচনা করতে হবে।
কোনো রাষ্ট্র যদি ক্রমাগত একটি নির্দিষ্ট পক্ষকে তার অপরাধের পরও পার পেয়ে যেতে সহায়তা করে, তাহলে সেই দেশটিকে শান্তি রক্ষাকারী দেশ বলে আর বিশ্বাস করা যায় না। ইসরাইলকে জবাবদিহি থেকে বাঁচিয়ে দিয়ে ওয়াশিংটন শুধু নিজের বিশ্বাসযোগ্যতাই নষ্ট করছে না; বরং যে আন্তর্জাতিক ব্যবস্থা রক্ষার দাবি সে করে, তাকেও দুর্বল করে দিচ্ছে।
জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদে ওয়াশিংটনের বারবার ভেটো ব্যবহার, তদন্তে বাধা প্রদান এবং আন্তর্জাতিক আদালতে ইসরাইলকে রক্ষা করার ফলে একধরনের দায়মুক্তির সংস্কৃতি তৈরি হয়েছে। আজকের সংকট এই আচরণের প্রত্যক্ষ ফল।
গালফ কো-অপারেশন কাউন্সিলের (জিসিসি) যৌথ নিরাপত্তা কাঠামো আজ কঠিন চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি। যদি কাতারের মতো একটি প্রতিষ্ঠাতা সদস্যকেও বিনা পরিণতিতে আক্রমণ করা যায়, তবে জিসিসির প্রতিরক্ষা কাঠামো অর্থহীন হয়ে পড়বে।
একইভাবে আরব লীগকে স্বীকার করতে হবে যে চলমান হামলাগুলো কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। এগুলো আরব ও মুসলিম বিশ্বের সার্বভৌমত্বকে দুর্বল করার জন্য একটি বৃহত্তর কৌশলের অংশ। সদস্যরাষ্ট্রগুলোর মধ্যে অনৈক্য ও দ্বিধা শুধু আগ্রাসনকে আরো উসকে দেবে।
তাই আঞ্চলিক রাষ্ট্রগুলো তাদের ভূখণ্ড ও জনগণকে সুরক্ষিত করার জন্য দৃঢ় পদক্ষেপ নিতে হবে। বিশেষ করে যখন ইসরাইল স্পষ্ট করে দিয়েছে যে তারা ভবিষ্যতেও এসব কর্মকাণ্ড চালিয়ে যেতে চায়।
শেষতক, এ সংকট শুধু আঞ্চলিক প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকবে না, আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানগুলোর কার্যক্রমকেও হুমকির মুখে ফেলবে।
জাতিসংঘকেও এখন একটি নাজুক পরিস্থিতির মোকাবিলা করতে হচ্ছে। প্রতিষ্ঠানটির প্রস্তাব অমান্য করা এবং আন্তর্জাতিক ম্যান্ডেটকে উপেক্ষা করার মাধ্যমে ইসরাইলের বিশ্বাসযোগ্যতাকে মারাত্মকভাবে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে। নাগরিকদের সুরক্ষা দেওয়া বা সংঘাত প্রতিরোধে জাতিসংঘকে অসহায় মনে হচ্ছে।
নিজের গুরুত্ব পুনরুদ্ধার করতে হলে জাতিসংঘকে প্রতীকী বিবৃতির বাইরে গিয়ে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কেও ইসরাইলের ওপর বাস্তব চাপ সৃষ্টি করতে হবে। নিষেধাজ্ঞা, আইনি জবাবদিহি এবং কূটনৈতিক সম্পর্কচ্ছেদের মতো পদক্ষেপের কোনো বিকল্প নেই।
কাতারের ওপর ইসরাইলের হামলা শুধু একটি সামরিক পদক্ষেপ ছিল না। এটি ছিল সার্বভৌমত্ব, স্থিতিশীলতা এবং শান্তিপূর্ণ উপায়ে সংঘাত সমাধান করার সম্ভাবনার ওপর আঘাত।
এত কিছুর পরও যদি রাষ্ট্রগুলো কঠোর ঐক্যবদ্ধ প্রতিক্রিয়া না দেখায়, তবে এটি একটি উদাহরণ হয়ে থাকবে। ফলে আগামী কয়েক দশকে এই অঞ্চল নতুন করে পুনর্গঠিত হবে এবং বিশ্বব্যবস্থাও অস্থিতিশীল হয়ে উঠবে।
আরব ও আন্তর্জাতিক নেতাদের এখন কঠিন সিদ্ধান্ত নেওয়ার সময় এসেছে। তারা হয় আঞ্চলিক স্থিতিশীলতা ও আন্তর্জাতিক শান্তি রক্ষায় পদক্ষেপ নেবেন, নয়তো দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কূটনৈতিক ব্যবস্থা ভেঙে পড়তে দেখবেন।
মিডল ইস্ট আই থেকে ভাষান্তর : এইচ এম নাজমুল হুদা